‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ সিনেমাটা অনেক বছর আগে কোন এক টিভি চ্যানেল দেখছিলাম। তাও শুরু থেকে না। চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে কোন চ্যানেলে এক চ্যানেলে, সিনেমাটার মাঝখান থেকে দেখা শুরু করে আর শেষ না করে উঠতে পারিনি। ছবিটা শেষ হলে খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে ছিলাম। এটা কি হইলো? লোকটার এখন কি হবে? মনে আছে, তখন ছবিটা মনে বেশ ভালো দাগ কেটেছিল।
যখন প্রথম বার ছবিটা দেখি, তখন ছবিটার নাম জানতাম না। কয়েকদিন আগে ইন্টারনেটে মুভির সাইটে ঘোরাঘূরি করতে করতে, পোস্টার দেখে বুঝলাম এই ছবিটা অনেক আগে মাঝখান থেকে দেখেছিলাম। টরেন্ট সাইট থেকে মুভিটা নামায়ে এক নিঃশ্বাসে পুরা ছবিটা আবার দেখলাম আজকে। মনে হল অন্যদেরকে ছবিটার কথা বলা যেতে পারে, মানে যারা ছবি দেখে।
‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ সিনেমাটা হলিউডের সিনেমা না। বসনিয়ান ছবি। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা যুদ্ধের উপর ছবিটা। ১৯৯৫ এর দিকের যুদ্ধের মধ্যে, একদিনের সকাল থেকে সন্ধ্যার ঘটনা নিয়ে পুরো সিনেমাটা। সিনেমার কাহিনীটা সংক্ষেপে এরকম। বসনিয়ান এবং সার্বদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। এই দুইপক্ষের যুদ্ধের মধ্যে, এক সকালে, ফ্রন্টলাইনে নো-ম্যানস ল্যান্ডে এক পরিত্যক্ত ট্রেঞ্চে, একজন বসনিয়ান (‘চিকি’) এবং একজন সার্ব (‘নিনো’) আটকা পড়ে, আহত এবং সশস্ত্র অবস্থায়। ঐ ট্রেঞ্চে আরও একজন আহত বসনিয়ান (‘চিকির বন্ধু’) আটকা পড়ে একটা এক্টিভেট করা তাজা মাইন এর উপরে, যাকে আগে মৃত ভাবা হয়েছিল। ইইউ এর তৈরী মাইনটা একটু অন্যরকম, চাপ পড়লে মাইনটা এক্টিভেট হয়, কিন্ত সঙ্গে সঙ্গে ফাটে না। মাইনটা ফাটবে চাপটা সরে যাওয়ার সাথে সাথে, মানে যে আহত লোকটা মাইনের উপরে পড়েছে, সে যদি সব্রে যাওয়ার চেষ্টা করে।
মুল সিনেমার শুরু এখান থেকে। জাতিগত ভাবে বৈরী একজন বসনিয়ান এবং একজন সার্ব যুদ্ধের মধ্যে আহত এবং সশস্ত্র অবস্থায় এক ট্রেঞ্চে। সাথে আরেকজন আহত শুয়ে আছে তাজা মাইনের উপর। ওই এলাকায় কর্মরত জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পুরো ঘটনাটা প্রথমে উপেক্ষা করে এবং চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্ত ওই এলাকায় যুদ্ধ কভার করতে আসা এক মহিলা সাংবাদিক ঘটনাটা জেনে যায়। সে মিডিয়াতে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয়ায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয়। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী আহত চিকি এবং নিনোকে উদ্ধার করে এবং মাইন ডিফিউজ করতে লোক পাঠায়। এর মধ্যে আটকা পড়া থেকে উদ্ধার হওয়া বসনিয়ান(‘চিকি’) রাগ এবং ক্ষোভ থেকে সবার সামনে এবং মিডিয়ার ক্যামেরার সামে মেরে ফেলে সার্ব (‘নিনো’) কে। আর ‘চিকিও সাথে সাথেই মারা যায় শান্তিরক্ষী বাহিনী হাতে। আর অন্যদিকে, মাইন ডিফিউজ করতে আসা লোক চেষ্টা করার পরে জানায়, এই মাইন ডিএক্টিভ করা সম্ভব না।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ইনচার্জ, মাইনের উপর উপরে পড়ে থাকা লোকটার ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়ার জন্য, মিডিয়ার সাথে মিথ্যা বলে যে লোকটাকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং চিকিৎসার জন্য অন্যখানে নেয়া হচ্ছে। প্রমান হিসেব দূর থেকে সাজানো স্ট্রেচার হেলিকপ্টারে তোলা দেখায়। অন্যদিকে, যুদ্ধরত বসনিয়ান এবং সার্ব বাহিনীকে ধারনা দেয় রাতে ওই ট্রেঞ্চ থেকে আক্রমন হতে পারে। কারন সেই শান্তিরক্ষী বাহিনীর ইনচার্জ আশা করে রাতে দুইপক্ষের বোমাবর্ষনে ওই ট্রেঞ্চ, মাইনের উপর পড়ে থাকা মানুষটা সব ধবংস হয়ে সব প্রমান মুছে যাবে। এভাবে পুরো ঘটনার সন্তোষজনক সমাধান করে, মিডিয়া, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী, কমান্ডার সবাই সন্ধ্যার দিকে জায়গাটা ছেড়ে চলে যায়। শুধু আহত মানুষটা একাকী পরে থাকে তাজা মাইন এর উপর, মৃত্যুর অপেক্ষায়। এখানেই সিনেমাটা শেষ।
একটু আগে উইকিপিডিয়াতে দেখলাম, ছবিটা অস্কার এবং বেস্ট বিদেশী সিনেমা হইছে ২০০১ এ। নিচে লিঙ্ক দিলাম, যদি আগ্রহী হন সিনেমাটা দেখতে পারেন। দেড় ঘন্টার ছবি। সময়টা অপচয় হবে না। হলিউডের মগজ ধোলাই মার্কা ওয়ার মুভির চাইতে অনেক ভালো।
সিনেমা থেকে ইতিহাস বা সত্যটা জানার চেষ্টা করা খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর আমিও যুদ্ধের সিনেমার খুব ফ্যান নই। তারপরেও কিছু কিছু সিনেমা (অবশ্যই হলিউডের টিপিকাল ওয়ার মুভি না) মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যুদ্ধের সিনেমায় একশন, যুদ্ধ, ট্যাঙ্ক, হেলিকপ্টার, একে-৪৭, স্নাইপার, গোলাবারুদ, সাদা চামড়ার বীরত্ব এর বাইরে আর একটা জিনিশ থাকে, যেটার নাম মানুষ।
অফটপিকঃ
১। একই ট্রেঞ্চে একজন বসনিয়ান এবং একজন সার্ব যুদ্ধের মধ্যে এবং সশস্ত্র অবস্থায়, ‘নো ম্যানস ল্যান্ডে’ । ব্যাপারটা যে কেমন ভয়াবহ তা একটু ব্যখ্যা করা দরকার। কিন্ত চিন্তা করেও এর কাছাকাছি সমকালীন কোন উদাহরন পাচ্ছিনা।
২। সিনেমাতে একটা চরম ক্রাইসিস মুহুর্তে, নারী সাংবাদিক বসনীয় মানুষটাকে জিজ্ঞেস করে, আপনার অনুভুতি কি(হাউ ডু ইউ ফিল)? আমার কেন জানি ওই মুহুর্তে মুন্নী সাহার রিপোর্টিং মনে পড়ে গেল। সব রিপোর্টার বোধহয় একরকম
৩। মাইন ডিফিউজ করতে আসা লোকটার কাজের ব্যাপারে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর একজন আরেকজনকে বলে, এরা জীবনে মাত্র একটা ভুল করে
৪। মোস্তফা সারয়ার ফারুকীর পরের ছবিটার নাম, ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ আর এটার নাম ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’
টরেন্ট লিঙ্ক :