১। দুনিয়াজোড়া নতুন ব্লকবাস্টার হলিউডি মুভি মুক্তি পেয়েছে। মুভির নাম ‘পানামা পেপারস’। নায়ক, পরিচালক, প্রযোজক, ক্যামেরাম্যান এবং মিডিয়া পার্টনার, সব পশ্চিমা এস্টাব্লিশমেন্ট আর ভিলেন হল বাকি দুনিয়ার কিছু নামকরা মানুষ। ছবির প্রথম অর্ধেক সিনেমা হলগুলোতে দেখানো হয়েছে। এখন সাময়িক বিজ্ঞাপন বিরতি চলছে।
২। ব্যাবসা বানিজ্যের সফলতার একটা প্রধান উপায় ব্রান্ড ইমেজ দাড়া করা। পানামার ওকালতি কোম্পানির কাগজপত্র ফাস হওয়ার খবর আসার দুই এক দিনের মধ্যে খেয়াল করলাম করলাম, মেইনস্ট্রিম মিডিয়াগুলো একটা ব্রান্ড দাড়া করায়ে ফেলেছে, ‘পানামা পেপারস’। যেটা আগের কোন গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার ক্ষেত্রে হয়নি, যেমন এডোয়ার্ড স্নোডেন এর ক্ষেত্রে ‘ স্নোডেন পেপারস’ বা ‘ম্যানিং পেপারস’। এ ধরনের দ্রুত এবং দুনিয়াজোড়া ব্রান্ডিং এর পেছনে খুব বড় কোন খেলোয়াড়ের সাপোর্ট না থাকলে হওয়ার কথা না। আর ব্রান্ডিং এর জন্য যে ছবিটা ব্যাবহার করা হয়েছে, একটা লোকের মাথার পেছন দিকে ছবি, মুখ দেখা যাচ্ছে না, চারিদিকে বেয়ারার বণ্ড পেপার উড়ছে বাতাসে। এখানেও সিনেমার সাসপেন্স, কে ওই লোকটা? আপনি নাতো? বা আপনার দেশের কোন বড়সড় কে আছে সিনেমায় ভিলেন হিসেবে?
৩। পানামা পেপারসকে এখন মহান হুইসেল ব্লোইং হিসেবে দেখানো হচ্ছে। যেই ঘটনা বা প্রতিষ্ঠানের পেছনে জর্জ সোরোস এবং রকফেলার এর মত নমস্য ব্যাবসায়ীরা জড়িত, সেটা আর যাই হোক হুইসেল ব্লোইং হতে পারে না। এরকম ইতিহাস নাই। আজকে ইণ্টারনেটে পড়ছিলাম, ব্রাজিল এর প্রসিডেন্ট ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট দিলমা রৌসেফের এর ইম্পিচমেন্ট এর পেছনেও জর্জ সোরোস জড়িত বলে ধারনা করা হচ্ছে।
৪। পানামার এই ওকালতি কম্পানির আমেরিকাতে ব্রাঞ্চ অফিস আছে এবং সেখানে তাদের চাকুরের সংখ্যা ১৪৫। এই ১৪৫ জন আমেরিকার অফিসে বসে টেবিল মুছত এবং মাছি মারত। আমেরিকার সকল আমলা, ব্যাবসায়ী, অভিনেতা, করপোরেশন এবং সবার উপরে রাজনীতিবিদরা সকলেই সৎ, এরকম ভাবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারন কারন এবং ইতিহাস নাই। তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি কিছু আমেরিকান ভিলেন আছে এবং ‘পানাম পেপারস’ মুভির পরের অংশে কিছু আমেরিকান ভিলেন থাকলেও থাকতে পারে, একটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখার আইওয়াশ এর জন্য।
৫। ‘পানামা পেপারস’ এর কোন পাবলিক ডাউনলোড লিঙ্ক নাই। বলা হচ্ছে আমাদের কাছে আছে সবগুলো পেপার, যার কিছু শুধুমাত্র আমাদের নির্বাচিত সঙ্গীসাথীদের দেখতে দিছিলাম। তা থেকে ‘কিছু কিছু’ তোমাদের দেখাচ্ছি। সেই ‘কিছু কিছু’ কেমনে নির্ধারন করা হচ্ছে? নিশ্চয় দুর্গন্ধযুক্ত কোন যুক্তি আছে।
৬। ‘পানামা পেপারস’ মুভিতে এখন পর্যন্ত দুনিয়াজোড়া দর্শকদের যতটুকু দেখানো হয়েছে তার মধ্যে যথারীতি সিনেমার ফর্মুলামত, মারদাংগা মারামারি এবং নায়িকার বৃষ্টিতে ভেজার মত উত্তেজক দৃশ্য আছে। যা নিয়ে দুনিয়াজোড়া এরমধ্যেই ছিঃ ছিঃ ধিক্কার পড়ে গেছে। চেয়ার টেবিল নিয়ে দিকে-দিকে, দেশে-দেশে তদন্ত কমিটি বসে গেছে, নায়িকার বিচার করতে, শরীরের কতুটুকু দেখা গেছে, তা বিচার করতে। পরিচালক সিনে নাই।
৭। ‘পানামা পেপারস’ এ যাদের নাম বের হয়েছে, শুধু যে তারাই ক্ষতিগ্রস্থ তা কিন্ত না। দুনিয়ায় বহু কস্টে তৈরী করা এবং টিকিয়ে রাখা অল্প যে কয়েকটা ট্যাক্স হ্যাভেন আছে, তার মধ্যে প্রধান একটা, ‘পানামা ট্যাক্স হ্যাভেন’ ডুবল। তার সুনাম বা গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে গেছে বা যাবে। এবং সামগ্রিক ভাবে ‘সেফ ট্যাক্স হ্যাভেন’ এর ব্রান্ড ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে মারাত্বক ভাবে। এটা অবশ্যই পশ্চিমা এস্টাব্লিশমেন্ট জন্য একটা বিরাট ক্ষতি। এই বিরাট ক্ষতিটা মেনে নেয়া সম্ভব, যদি এই ক্ষতি থেকে, তার চেয়ে বড় কোন লাভ করা যায়। ব্যাপারটা মনে হয় পরিস্কার করতে পারলাম না। অন্য একটা উদাহরন দিই। সুইস ব্যাংকের। সুইস ব্যংকের ব্যাপারটা তো জানেন। সুইস ব্যংকগুলো দুনিয়ার তাবত বড় বড় দুই নাম্বার লোকের টাকা নিরাপদে জমা রাখে এবং তা সংক্রান্ত কোন তথ্য, এমনকি সেই দেশের সরকারকেও দেয় না। এখন ভাবুন কিছু সুইস ব্যংকের, কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিবেকের তাড়নায়, সেই সব বড় বড় দুই নাম্বার লোকের টাকার তথ্য এবং বাকি সব ডিটেলস দুনিয়ার কাছে ফাঁস করে দিল। ঘটনাটা কি দাড়াবে। ‘সুইস ব্যাংক’ নিরাপদ দুনিয়াজোড়া এই বিশ্বাসটা বিরাট একটা ধাক্কা খাবে এবং সুইস ব্যংকের উপরে থেকে মানুষের ভরসা কমে যাবে। মার্কেটিং এর ভাষায় ‘সুইস ব্যাংকের’ ব্রান্ড ইমেজ মারাত্বক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশ হিসেবে সুইজারল্যন্ড এরও এটা বিরাট একটা ক্ষতি। পানামার ‘সেফ ট্যাক্স হ্যাভেন’ এর ইমেজ ক্ষতির ব্যাপারটাও এইরকম।
৮। আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর নাম কেন ‘পানামা পেপারস’ এ ফাঁস করা হল, সেটা বোঝা কিন্ত খুব কঠিন না। সম্প্রতিক কালে আইসল্যান্ড একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার ঘটায়েছিলে। এখনকার চলতি বা নতুন ফ্যাশন হল, ‘নতুন কিছু কর’ বা ‘পরিবর্তন দরকার’ স্লোগান দিয়ে ভোট চাওয়া এবং ভোটের পরে কোন গুনগত পরিবর্তন না হওয়া। কোন স্লোগান বা বড় বড় কথা ছাড়াই আইসল্যান্ড একটা বিশাল পরিবর্তন করেছিল। আইসল্যান্ডের বড় বড় ব্যাংকগুলো যখন নিজেদের সীমাহীন লোভ এবং মার্কেট ম্যানুপুলেশনের কারনে ডুবছিল, আইসল্যান্ড সরকার ব্যাংকগুলোকে ডুবতে দিয়েছে। জনগনের ট্যাক্সের টাকা ব্যাংকার পকেটে ঢেলে দেয়নি, তাদের উদ্ধার করতে, যাকে বলে বেলআউট। আমেরিকা যেটা করেছে, কিছুদিন আগে। এবং তার চেয়ে বড় কথা, দুর্নীতি এবং মার্কেট ম্যানুপুলেশনের জন্য ২৬ জন ব্যাংকারকে জেল ঢুকায়েছে। ব্যাংকের পিওন বা কেরানী না, ব্যাংকের বড় বড় ব্যাংকার। এরকম সাহসী ঘটনা সাম্প্রতিক কালের পৃথিবীর ইতিহাসে নাই। দুনিয়ার আর কোন সরকার, আবার বলি, দুনিয়ার আর কোন সরকার, ব্যাংকিং কার্টেলদের বিরুদ্ধে মেরুদন্ড সোজা করে, চোখে চোখ রেখে ব্যাংগুলোর সামনে দাড়ানোর সাহস দেখাতে পারেনি। তো ‘পানাম পেপারস’ দিয়ে এক ঢিলে দুইটা কাজ হল। ব্যাংকার গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কিছুটা শোধ নেয়া হল ব্যাংকারদের বেইজ্জতি করার জন্য। এবং তারচেয়ে গুরুত্বপুর্ন হল, বাকি দুনিয়ার সকল সরকারকে একটা পরিস্কার মেসেজ দেয়া হল, আইসল্যান্ডের অনুকরন করে ব্যাংকিং কার্টেলদের ঘাটাতে গেলে, যে কোন সরকারের খবর আছে।
৯। কোন ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে এরকম একগাদা কাগজ তাকে কি পরিমান ক্ষমতা দেয়, অনুমান করতে পারেন? একটা হলিউডি সিনেমার কথা বলি। ছবির নাম ‘দ্যা আনটাচেবলস’। কেভিন কস্টনার আর শন কনেরীর ছবি। আমেরিকান গ্যাংস্টারদের নিয়ে। দুস্টের দমন, শিস্টের পালন টাইপ মুভি। ছবির শেষ দিকে নায়ক কেভিন কস্টনার কিছু কাগজ পায় (ঠিক ‘পানামা পেপারস’ এর মত কাগজ), যা দিয়ে গ্যাংস্টারদের অফিসিয়ালি দোষী প্রমানিত করে জেলে পাঠানো সম্ভব। সমস্যা হলো বিচারক এবং জুরিরা যারা রায় দেবেন তারাও বদ গ্যাংস্টারদের পক্ষে। এই কাগজগুলো দিয়ে নায়ক কেভিন কস্টনার, বিচারককে বাধ্য করে তার পক্ষে রায় দিতে বা কাজ করতে। নায়ক বিচারককে একান্ত সংগোপনে বলে, “আপনার নামও কিন্ত এই কাগজগুলোয় আছে, জনাব”। এটাকে সাদা বাংলায় বলা হয় ব্লাকমেইল। ফাটা বাশের চাপে পড়া সেই বিচারকের আর অন্যকোন বিকল্প থাকেনা, নায়ক বাধ্যগত হয়ে কাজ করা ছাড়া।
১০। এই ‘দ্যা আনটাচেবলস’ মুভির ঘটনা বাস্তবে ঘটানো কিন্ত খুবই সম্ভব পানামা পেপারস দিয়ে। যার হাতে এই সবগুলো পেপারস, তার এখন দুনিয়াজোড়া কি পরিমান ক্ষমতা অনুমান করতে পারছেন কি? ব্যাবসা, বানিজ্য, ভোট, পলিসি, রাজনীতি, আইন কানুন, সরকারকে চাপে রাখা, বিরোধী দলকে চাপে রাখা সবই সম্ভব। এবং তার চেয়ে খারাপ কথা, এই ক্ষমতা একটা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না, এই ক্ষমতা দুনিয়া ব্যাপী। শুধু কেভিন কস্টনার এরমত ফিসফিস করে ঠিক লোকটার কানে কানে বলতে হবে, “তোমার নামও কিন্ত ‘পানামা পেপারস’ এ আছে, হে”! কয়েকদিন আগে দেখলাম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট স্বীকার করেছেন, লিবিয়ার ব্যাপারে ভুল করা হইয়েছে (যদিও অনেক তেনা প্যাচায়ে)। এটা যে ‘পানামা পেপারস’ এর কোন সাইড ইফেক্ট না, কে জানে!
১১। মুভি রিলিজ দেয়ার দিন-তারিখ ঠিক করা হয় অনেক হিসাব করে। এখন কেন পানামা পেপারস মুভি রিলিজ দেয়া হল? অবশ্যই তারও কোন কারন আছে।
১২। এখন বলা হচ্ছে এই ‘পানামা পেপারস’ মুভি রিলিজ হয়েছে, রাশিয়া বা প্রেসিডেন্ট পুতিন কত খারাপ আর দুর্নীতিপরায়ন তা দেখানোর জন্য। এটা নিশ্চিত ভাবে মশা মারতে কামান দাগার মত, কারন এই পেপার সরসরি পুতিন এর বিরুদ্ধে কিছুই প্রমান করে না। যেমন করেছিল, ক্লিনটনের মনিকা লিউনেস্কির পরনের জামার প্যাথলজিকাল টেস্টের রিপোর্ট। পশ্চিমা এস্টাব্লিশমেন্ট এতটা বেকুব না, যে মশা মারতে কামান দাগাবে। তারা অবশ্যই কোন দুর্গ তাক করেই কামান দেগেছে। কথা হল কোন সেই দুর্গ?
১৩। আমার মত আদার ব্যাপারির ধারনা ‘পানামা পেপারস’ এর মুল লক্ষ্য আমেরিকার নির্বাচন। এখন সমস্যা হলো দুর্গতো দুইটা। একটার সামনে হাতি বাধা আরেকটা দুর্গের সামনে গাধা বাধা। কোন দুর্গটা কামানের টার্গেট? আমার সহজ স্বীকারোক্তি, আমার মত আদার ব্যাপারি এটা জানে না।
১৪। তবে আদার ব্যাপারী, অন্য আর একটা একটা বিকল্প অনুমান করতে পারে অবশ্য। ব্যাপারটা এমন হতে পারে, ‘পানামা পেপারস’ এর পরিচালক বলল, তোমরা দুই দুর্গওয়ালারা যুদ্ধ কর। যুদ্ধ করে যে জিতবে, আমি তার বস, কারন আমার হাতে আছে ‘পানামা পেপারস’। এটাই ব্যাবসায়িক দিক থেকে সবেচেয়ে নিরাপদ এবং ভালো সিদ্ধান্ত। সবচে কম বিনিয়োগ, কম ঝুকি কিন্ত লাভ সবচেয়ে বেশি। একজন ঝানু ব্যাবসায়ীর পক্ষে এটা করাই সবচেয়ে লজিকাল।
১৫। যাই হোক, ‘পানামা পেপারস’ মুভি রিলিজ হয়েছে এপ্রিলের তিন বা চার তারিখে। এখন চলেছে তার বিজ্ঞাপন বিরতি। পরিচালক তার ক্ষমতার নমুনা সারা দুনিয়াকে দেখিয়ে দিয়েছে ছবির প্রথমে অর্ধেকে। এখন বিজ্ঞাপন দেয়া হছে ভিলেনদের দেখানোর জন্য, দেখ আমার হাতে কি আছে। হতাশ হয়েন না, বিজ্ঞাপন বিরতির পরে আবার মুভি শুরু হবে মে মাস থেকে, তাদের ঘোষক ওয়েবসাইটে জানিয়েছে। জাস্ট স্টে টিউনড। পশ্চিমা ধান্দাবাজি উইল বি ব্যাক সর্টলি। ডোন্ট গো অ্যাওয়ে।
২৭-এপ্রিল-২০১৬, ঢাকা।