দুই তিনদিন আগে প্রথম আলোতে একজনের সাক্ষাৎকার পড়ছিলাম বাংলাদেশের খাদ্য সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে। ওখানে বলা অনেক কথার মধ্যে এরকম দুইটা কথা ছিল, আমাদের দেশের (১) ১৫ শতাংশ পরিবার জানে না পরের বেলার খাবার পাওয়া যাবে কিনা আর (২) ৭ শতাংশ পরিবার কখনো তিন বেলা খাবার পায় না।
আমার মত শহুরে মধ্যবিত্তের সাথে আপাত সম্পকহীন নিরীহ পরিসংখানগত তথ্য। পরে অবসর সময়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার পর ব্যাপারটা এত ভয়াবহ মনে হল যে মাথা থেকে কিছুতেই সরাতে পারছিনা। আমাদের দেশের মানুষগুলো গরীব এটা জানতাম; কিন্ত কতজন মানুষ, কি পরিমান গরীব, উপরের তথ্য দুইটা আমাকে চোখে আংগুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দিল।
তথ্য দুটিকে যদি নিজের সাথে সম্পর্কিত করে একটু ভিন্ন ভাবে দেখি, তবে ব্যাপারটা দাড়ায় এরকম:
১) সকালে নাস্তা শেষ করে, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, যখন পেপারের হেডলাইনে চোখ বুলাই, দিন-দুনিয়ার খবর জানার জন্য; তখন নাস্তা শেষ করে, আমার দেশের সোয়া দুই কোটি লোক চিন্তা করে দুপুরে খেতে পাবে কিনা নাকি না খেয়েই থাকতে হবে দুপুরে।
২) আবার রাতে খেয়ে দেয়ে, টিভি দেখে আমি যখন ঘুমাতে যাই, তখন আমার সাথে যে ১৫ কোটি লোক ঘুমাতে যায়, তাদের মধ্যে এক কোটি লোক ঘুমাতে যায় খালি পেটে, না খেয়েই।
মনটা একটু খুত খুত করলেও, ব্যাপারটাকে তারপরেও অতটা ভয়াবহ মনে হলোনা। একটুপর বুঝলাম, আসলে এক কোটি লোক না খয়ে ঘুমতে যায়; এই এক কোটি লোক মানে কত লোক, এই ধারনাটাই আমার নাই। আমার ধারনা আছে, এমন কোন মাপের মধ্যে যেমন গজ, ফুট, ইন্চি এর মাপে যদি এই এককোটি লোককে আনা যায়, তাহলে হয়ত কিছুটা বুঝতে পারব।
কাগজ কলম নিয়ে হিসেব করে বোঝার চেস্টা করলাম, কত মানুযে সোয়া দুই কোটি মানুষ হয় বা কত মানুষে এক কোটি মানুষ হয়?
হিসেব করে দেখলাম, যে সোয়া দুই কোটি মানুষ সকালে নাস্তা করার পর জানেনা, তারা দুপুরে এক থালা ভাত খেতে পাবে কিনা; তারা যদি হাত ধরাধরি করে (মানববন্ধন স্টাইলে আরকি) ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে বারাবর লাইন করে দাড়ায় তবে আপনাকে ১০৪ বার ঢাকা-চট্টগ্রাম যাতায়াত করতে হবে লাইনের প্রথম মানুয থেকে শেষ মানুয পর্যন্ত মাত্র একবার যেতে! এই এতগুলো মানুষের প্রত্যেকটা মানুষ সকালে জানেনা দুপুরে খেতে পাবে কিনা! শুধু একদিন সকালে না, প্রত্যেকদিন সকালে !
এরপরেও পরিষ্কার হলোনা! ঠিক আছে, একটা কাজ করবেন। এর পরের বার যখন নাইটকোচে ভলভো এসি বাসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবেন, তখন এই লেখাটার কথা মনে করবেন। তারপর বাসের কাচের ভেতর থেকে রাস্তার দুই পাশে তাকাবেন। ভাববেন না খেতে পাওয়া আমাদের দেশের এই লোক গুলো, রাস্তার দুই পাশের রাতের অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে লাইন করে। শুকনো মুখে । হাতে হাত ধরে। রাস্তার বাম ধারে ২৪ সারি লোক, রাস্তার ডান ধারেও ২৪ সারি লোক। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পুরোটা রাস্তা। মোট ৪৮ সারি। এরা হলো সেই এককোটি লোক, যারা যখন আপনি ঘুমাতে যান, এরাও ঘুমাতে যায়, না খেয়ে। এদের প্রত্যেকটা লোক, প্রত্যেক রাতেই।
আমি এখন বিশ্বাস করি; আমাদের মত গরিব দেশে, সকালের নাস্তা নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করা বা শখ করে রাতে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট বা গুলশান বনানীর দামী রেস্টুরেন্টগুলোতে খেতে যাওয়া একরকম পাপ।
বি:দ্র: ব্যাপারটা বোঝার জন্য আমি যে তথ্য/অনুমান ব্যাবহার করেছি তা হলো (১) আমাদের মানুষ এখন ১৫ কোটি (২) ১৫ শতাংশ পরিবারকে গড়ে ১৫ শতাংশ মানুষ ধরেছি সহজ হিসেবের জন্য (৩) মানববন্ধনে গড়ে ৪ ফুট জায়গা লাগে একজনের জন্য আর (৪) ঢাকা চট্টগ্রামের দুরত্ব ২৬৪ কিলোমিটার।